এম রেজা টুনু সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ
সুনামগঞ্জের ছাতকে সুরমা নদীতে চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় নিরীহ দু’যুবককে ষড়যন্ত্রমুলক ভাবে পুলিশের জালে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বুধবার ছাতক পৌর শহরে একটি চায়ের দোকান থেকে একে একে দু’যুবককে থানায় নিয়ে আটক করা হয়।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন বিকেল অনুমানিক ৫টার দিকে থানার সামনে স্বাধীন বাংলা চায়ের হোটেলে বসে চা পাণ করছিলেন উপজেলার চরেরবন্দ গ্রামের মৃত.চান মিয়ার ছেলে খালেদ মিয়া ও রহমতপুর গ্রামের মৃত. নেছার আহমদের ছেলে মো. দুদু মিয়া। এ সময় সিভিল পোশাকে আসেন থানার ওসি তদন্ত মঈন উদ্দিন ও এস আই দিলোয়ার হোসেন, এ এস আই শাহ জামাল। ডিবির অফিসারের কথা বলে দুদু মিয়াকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দুদু মিয়া ফিরতে দেরি হওয়ায় তার খোঁজ খবর নিতে থানায় যান খালেদ মিয়া। পরে দুজনকেই থানায় আটকে রাখা হয়।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ খালেদ মিয়া তার ফেইসবুক আইডিতে নৌ-পথে নামে-বেনামে চাঁদাবাজী বন্ধে প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করে বিভিন্ন সময় পোষ্ট করেছেন। এতে স্বার্থান্বেসী মহল ষড়যন্ত্রমুলক ভাবে প্রকৃত চাঁদাবাজ রাগব বোয়ালদের আড়াল করার জন্য খালেদ ও দুদু মিয়াকে পুলিশের জালে ফাঁসানো হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারের দাবী সঠিক তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।
থানা পুলিশ সুত্র জানায়, খালেদ ও দুদু মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জন ব্আেইনভাবে মিলিত হয়ে নৌ-যান, বাল্কহেড হতে লাঠি দ্বারা ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা দাবি করার অপরাধে পেনাল কোড ১৪৩, ৩৮৫, ৩৮৬ ও ৫০৬ ধারায় ১১ মার্চ ২০২০ ইং তারিখে ছাতক থানায় মামলা নং-১১ দায়ের করা হয়।
মামলার এজহার সুত্রে জানা যায়, উপজেলার গনেশপুর সংলগ্ন খেয়াঘাট সুরমা নদীতে হাতে লাঠি ও রড নিয়ে নদীর পারে অবস্থান করে নদীতে চলাচলরত নৌ-যান হতে জোরপূর্বক চাঁদা দাবি করিয়া চাঁদা আদায় কালে তাদেরকে আটক করা হয়। আটকৃতদের নিকট থেকে ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন ছাতক শাখা নামে একটি চাঁদা আদায়ের রশিদ ও নগদ ১ হাজার ৫শত টাকা জব্দ করে পুলিশ।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, থানার এসআই দিরোয়ার হোসেন বাদী হয়ে দায়েরী মামলার এজহারে একটি রশিদ জব্দ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নৌ-পথে নামে বেনামে অবৈধ ভাবে আদায়কৃত চাঁদার রশিদ বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করে প্রশাসনের দৃষ্টি কামনায় ফেইসবুকে পোষ্ট করতেন খালেদ ও দুদু মিয়া। এছাড়া একজন সাধারন লোকের নিকট দেড় হাজার টাকা থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। প্রকৃত চাঁদাবাজদের আড়াল করতেই অত্যন্ত কৌশলে দুদু মিয়াকে চায়ের দোকান থেকে থানায় ডেকে নিয়ে ফাঁসানো হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারের দাবী।
জানা যায়, এর আগে গত বছরের ১৪মে রাতে সুরমা নদীতে চাঁদাবাজি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে পৌর শহরে আ’লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাহাব নামে এক ব্যাক্তি। ওই সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় ব্যবাসায়ীসহ প্রায় চারশতাধিক ব্যাক্তিকে আসামি করে পৃথক তিনটি মামলাও করা হয়। চাঁদাবাজি নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনার পর বেশ কয়েকমাস গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর ছাতক-কোম্পানীগঞ্জ নৌ-পথের চাঁদাবাজরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন এ নৌ-পথের পয়েন্টে পাথর-বালু, চুনাপাথরবাহী বার্জ-কার্গো ও নৌকা থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চাঁদাবাজরা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কতৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ ইঞ্জিন এন্ড বাল্কহেড বোট ওনার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাতক পৌরসভা, কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীতে পাথর আহরনকারী নৌকা হতে টেক্স আদায় মহাল (উপজেলা টেক্স) এবং বিভিন্ন নদীপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ও পাথরবাহী ইঞ্জিন চালিত ও ইঞ্জিনবিহীন কেজা/বৈঠা) নৌযান হতে উপজেলা ট্রাক্স আদায় রশিদ, উপজেলা বাস-কার্গো মহাল (উপজেলা টেক্স) কোম্পানিগঞ্জ, মেসার্স বরকতিয়া টেডার্স, যুব ও সমাজ কল্যান সংস্থা, সায়েম এন্টার প্রাইজ, সহ বিভিন্ন নামে ৪শত টাকা থেকে ১ হাজার ৫শত টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক ব্যাক্তি নিহত হওয়ার পর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়। কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দপ্তরে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগও করা হয়। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবীতে স্থানীয় সংসদ সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পৃথক ভাবে বৈঠকও করেন।
পুলিশ ও র্যাবের পৃথক পৃথক অভিযানে বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। তার পরও কিছুতেই থামছেনা চাঁদাবাজি। অপরদিকে অব্যাহত চাঁদাবাজির ঘটনায় মুলহোতাদের আড়ালে রেখে নিরীহ লোকজনকে হয়রানী করারও অভিযোগ উঠেছে।
ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সুরমা, চেলা এবং পিয়াইনে নৌ-পথে বালু, পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা নিতে আসে বাল্কহেড, বার্জ, কার্গো ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌ-পরিবহন। এ ধরনের যান চলাচল বর্ষা মৌসুমে অনেকটা বেড়ে যায়। এসব নৌ-পরিবহন ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর কোয়ারিসহ বিভিন্ন কোয়ারি থেকে পাথর সংগ্রহ করে। এ ছাড়াও ভারত থেকে চুনাপাথর, বোল্ডার-সিঙ্গেল আমদানি করেও ছাতক নৌ-বন্দর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাম্পিং করা হয়। এসব স্থানের ব্যাবসায়ীদের নৌ-পরিবহনকে ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী নৌপথের ইছাকলস, চেলা নদীর মুখ, থানাঘাট, চাঁদনীঘাট, পেপারমিল ঘাট, নোয়ারাইঘাট, বারকাপন ও বাউসা এলাকায় চাঁদা দিতে হয়। এ কারনে ছোট-বড় শতাধিক নৌ-পরিবহনকে ঘাটে ঘাটে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে স্বাধীন বাংলা চায়ের হোটেলের চা-বিক্রেতা খসরু মিয়া বলেন, ঘটনার দিন আছরের নামাজের সময় ডিবি পুলিশের কথা বলে ছাতক থানার নতুন ওসি তদন্ত ও এ এস আই জামালসহ তিনজন অফিসার আমার চায়ের দোকান থেকে দুদু মিয়াকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে খোঁজ খবর নিতে খালেদ মিয়া থানায় গেলে দুজনকে আটকে রাখা হয়