ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মান
১ min read
সরকারিভাবে অবমূল্যায়ন না হলেও চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মান। অর্থাৎ টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হচ্ছে। যদিও পৃথিবীর নানা দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলার দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে বিপরীত প্রবণতা। টাকার মান কমার এই প্রবণতাকে জ্বালানি তেলের ব্যয় পরিশোধ ও আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার মতো নেতিবাচক প্রভাব থাকলেও রেমিটেন্স ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন অনেকে। তবে অন্য দুটি বড় মুদ্রা ব্রিটিশ পাউন্ড ও ইউরোর বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হয়েছে ব্যাপক। চলতি অর্থবছরের শুরুতে জুলাই মাসে যেখানে ৭৮ দশমিক ৪০ টাকায় এক ডলার কেনা যেত, সেখানে চলতি মার্চ মাসে ৭৯ দশমিক ৫০ টাকায় এক ডলার কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ আট মাসেই বেড়েছে ১ দশমিক ১০ টাকা। তবে এটি ব্যাংক হার, খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে আরও বেশি দামে। খোলাবাজারে ডলারের দাম ৮১-৮২ টাকা করে রাখা হচ্ছে। তবে এই মূল্যবৃদ্ধি ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও নগদ ডলারের সংকটের কারণে হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। পর্যটকদের আগমন কমে যাওয়া, রেমিটেন্সের নিম্নগামিতা ও রপ্তানি কমার কারণে চলতি হিসাবে ও নগদ দুই খাতেই ডলারের এ সংকট তৈরি হয়েছে। এতে ডলার শক্তিশালী হচ্ছে ও টাকার মান কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে দেশে আমদানিকারকদের ব্যয় বেড়ে যাবে। আমদানিনির্ভর আমাদের এই দেশে এটি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে অর্থনীতির সব খাতে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে সরকারের ব্যয়ও অনেক বাড়বে। এর বাইরে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও হজসহ নানা কারণে প্রবাসে বাড়বে দেশের সাধারণ মানুষের খরচ। তাই অনেকে ডলারের মূল্যকে স্থীতিশীল রাখার প্রস্তাব করেছেন। তবে এর বিপরীত মতও রয়েছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন দরকার বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের মতে, বহুদিন টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছিল। এখন সময় এসেছে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন করা। টাকার অবমূল্যায়ন করলে টাকার মান কমে যায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকা বেশি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মূলত ডলারের সরবরাহ কমায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি রেমিটেন্স ও রপ্তানি উভয়ই কমেছে। বিপরীতে আমদানি বেড়েছে। ফলে আমাদের চলতি হিসাবে (আমাদানি ও রপ্তানির জের) ডলারের পরিমাণ অনেক কমেছে। যা ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এতে ক্ষতি তেমন নেই। আমাদের দেশে ডলারের দাম অনেক দিন অতিমূল্যায়িত হয়ে আসছে। কিছুটা অবমূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এখন তা হলো। ফলে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়বে। এ ছাড়া খরচ বাড়লে অনেক ক্ষেত্রেই আমদানির চেয়ে দেশীয় পণ্যের উপর নির্ভর হবে দেশের মানুষ। যা আমাদের আমদানিকে কমাতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৭৯ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। তার আগে গত বছরের একই সময়ে ডলারের মূল্য ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সায়। গত বছরের জানুয়ারিতেও প্রায় কাছাকাছি ছিল। ওই সময় ডলারের গড় বিনিময় মূল্য ছিল ৭৮ টাকা ৫০ পয়সা।
গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষ পর্যন্ত ডলার প্রতি ৯৩ পয়সা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭৯ টাকা ৩৭ পয়সা।
চলতি মাসের শুরু থেকে গত ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭৯ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ জুলাই থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডলারের মূল্য বেড়েছে ১ টাকা ১০ পয়সা। তবে ব্যাংক ও কার্ভ মার্কেটে (খোলাবাজারে) ডলার কেনা-বেচায় ব্যবধান অনেক বেশি। কার্ভ মার্কেটে ডলারের মূল্য ৮১ থেকে ৮২ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ প্রতি ডলার কিনতে বাংলাদেশিকে খরচ করতে হবে ব্যাংক হারের চেয়েও দুই থেকে আড়াই টাকা বেশি। জানা যায়, রেমিটেন্স ও রপ্তানির বাইরে নগদ ডলারের সংকটও তৈরি হয়েছে দেশে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সিংহভাগই হয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক তথা নন ফিজিক্যাল ফর্মে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে বা দেশের বাইরে যাওয়ার সময় নগদ ডলার সঙ্গে নিতে হয়। বর্তমানে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশি হজ, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। এসবের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ডলার নেয়ার সীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে একই হারে বিদেশিরা আসছেন না। যে কারণে নগদ ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে অনেক ব্যাংক অনুমোদন নিয়েও ডলার আমদানি করতে পারেনি। উচ্চ কর ও শুল্ক হারের কারণে অনেকে এ ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়নি। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১৪ সালে দেশে নগদ ডলারের মজুদ ছিল ২ দশমিক ৪২ কোটি ডলার, ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২২ কোটি ডলারে। ২০১৬ সালের হিসাবে দেশে মজুদ নগদ ডলারের পরিমাণ ১ দশমিক ১৭ কোটি। বিশেষজ্ঞ এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে না পারলে এবং একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় কমাতে না পারলে ডলারের দামের ঊর্ধমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
এজন্য ডলার আমদানি করা, রেমিটেন্স বাড়ানো ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।