নির্বাসিত গণতন্ত্রে ফিরলেন হুম্মাম কাদের বাকীরা কোথায়?
১ min read
সায়েক এম রহমান :
যে দেশের মানুষেরা পাকিস্তানের শাসন, শোষন, ঝুলুম ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে, কোমরে গামছা বেঁধে নয়টি মাস যুদ্ধ করে লাখো শহিদের আত্মদানে অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই দেশটি আজ খুন, গুম, হামলা, মামলার দেশের পরিনত। যখন খুন, গুম, হামলা, মামলা ও মত প্রকাশকে রোধ করে দেশ পরিচালনায় ব্যস্ত আওয়ামীলীগ সরকার।
ঠিক তখনই অর্থ্যাত গত ১৮ ই ফেব্রুয়ারী শনিবার মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গুমের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিলো, গোলাম আজমের ছেলে বিগ্রে. জেনারেল আব্দুল¬াহিল আমান আযমী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী এবং মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর কাশেমের গুমের পিছনে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের হাত রয়েছে। এই অভিযোগটি তুলে ধরেছেন বৃটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান।
সংবাদটি প্রচার হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। অতপর: তার ৫ দিনের মাথায় অথ্যাত ২৩ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৩ ঘটিকার সময় ধানমন্ডি তাদের বাড়ির কাছেই কে বা কাহারা রেখে যায় সাত মাস নিখোঁজ থাকা হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে।
এখানে ফিরে আসা হুম্মাম আর আগের হুম্মাম অনেকই ব্যবধান। যেমনি ব্যবধান দেখা গিয়েছিলো, পাশ্ববর্তী দেশে ফেলে রাখা সালাউদ্দিন আহমদকে। ঠিক তারই মতো, নেই সুঠাম দেহ, নেই সেই চেহারা, দেখতে জীর্নশীন। মনে হয় যেন এইমাত্র কোন ব¬াকহোল থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। এতে প্রতিয়মান সুঠাম দেহী যুবক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জারত অবস্থায় ছিলো বিগত ৭টি মাস। যদিও এই লেখাটি, লেখা পর্যন্ত তাহার মুখথেকে কোন কথা শুনা যায়নি তবে সাধারন মানুষের ধারনা তিনি শারীরিক ও মানুষিক ভারসাম্য হয়তো হারিয়ে ফেলেছেন।
এখানে উল্লেখ্য ক্যাডম্যান আরো বলেছেন, এই তিনটি গুমের ঘটনা একটির সাথে আরেকটি নিবিড়ভাবে সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষকদের মতে, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার নাম এভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুম, খুনের সাথে জড়িত বলে প্রচারিত হওয়া, তা গর্বিত সেনাবাহিনীর জন্য নীতিবাচক হতে পারে এবং জাতিসংঘ মিশনেও তার প্রভাব পড়তে পারে।
এমতাবস্থায়, হুম্মাম কাদের চৌধুরী ফিরে আসার পর বাকী দুজনের ফিরে আসার ব্যাপারে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও স্বজনরা অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠছেন। সাথে সাথে আশাবাদী হয়ে উঠছেন ইলিয়াস পত্নী সহ শত শত গুম হওয়া পরিবারের স্বজনরা। সাধারন মানুষ এখন বলছেন, নির্বাসিত গণতন্ত্রে সালাউদ্দিন ফিরলেন, হুম্মাম ফিরলেন, কিন্তু বাকিরা কোথায়?
পাঠক অবশ্যই অবগত, গত বছরের ৪, ৯ এবং ২২ আগস্ট যথাক্রমে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বীন কাশেম এবং বিগ্রে. আব্দুল¬াহিল আমান আজমীদেরকে সিনেমা স্টাইলে সরকারী বাহিনী পরিচয়ে উঠিয়ে নেয়া হয়।
তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃস্টি হলেও কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ছিলো একদম নিশ্চুপ ভূমিকায়।
হুম্মান কাদের চৌধুরীকে কিন্তু তার মায়ের সামনে থেকে দিন দুপুরে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে থেকে ডিভি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। তারই চারদিন পর সুরক্ষিত এলাকা মিরপুর ডি এইচ এস এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেমকে। উলে¬খ্য, তাকে তুলে নেওয়ার আগের রাত র্যাব গিয়েছিলো বাসায় তাকে তুলে নিয়ে আসার জন্য। তখন মিরকাশেম র্যাবকে বলছিলেন, আমাকে কেন আপনাদের সাথে যেতে হবে? আর যদি যেতেই হয় ওয়ারেন্ট দেখান। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাকে না নিয়ে চলে যায়। কিন্তু পরের রাত সাদা পোষাকের বাহিনী ডিভি পুলিশ পরিচয় দিয়ে মা, বোন ও স্ত্রীর সামনে থেকে ফিল্মি স্টাইলে তুলে নিয়ে যায়।
ঠিক তার ১৩ দিন পর সেনাবাহিনীর জৈষ্ঠ কর্মকর্তা যিনি কর্মজীবনে সোর্ড অব অনার পেয়েছিলেন, বিগ্রে. আজমীকে নাজেহাল করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিভি পরিচয়ে সাদা পুলিশ। তাকে তুলে নেওয়ার পুর্ব মুহুর্তে বাসার আশপাশের রাস্তা যেন এক অন্য রকমের ফিল্ম শুটিং চলছিলো। ঐ সময় রাস্তায় লাগানো সি সি ক্যামরাগুলো খুলে ফেলা হয়, এমনকি তাদের বাসার সিসি ক্যামরা তছনছ করে ভেঙ্গে ফেলা হয়। এই ছিলো সেদিনের সাদা পোষাকের ডিভি পুলিশ নামে সরকার বাহিনীর কর্মকান্ড। তারপরও সরকারের আইনশৃৃখলা বাহিনী তাদের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী বলছে, এসমস্ত গুম বা নিখোজের ব্যাপারে তারা মোটেই অবগত নহে। যেমনি ভাবে সালাউদ্দিন আহমদ ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীর ব্যাপারে বলছিলেন। কিন্তু এদেশের জনতা এখন বলছে, গুম হওয়া শত শত মানুষের লাশ আমরা বাসতে দেখেছি, এদেশের খালে-বিলে ও নদীর কিনারায়। কাহারো লাশ মিলছে নীজ বাড়ীর আঙ্গিনায়।
আর যাদের গুম বা নিখোজ হওয়া লাশ মিলেনি কোন বাড়ীর আঙ্গিনায় বা খালে আর বিলে। তাদের স্বজনরা প্রতিটা মুহুর্ত অপেক্ষায় থাকে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য। যেমনি সালাউদ্দিন আহমেদ ও হুম্মাম কাদের স্বজনরা ছিলেন উপেক্ষিত।
আজ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হুম্মাম কাদেরকে ফিরিয়ে পাওয়ায় পরিস্কারভাবে প্রমানিত হয়ে গেলো যাদের লাশ পাওয়া যায়নি, তারা যেখানেই হোক যেভাবেই হোক এসরকারের হেফাজতেই আছেন।
সদ্য আরো প্রমানিত হলো, বর্তমান সংসদের হুইফ জনাবা মাহবুবা আক্তার গিনি সরকারের একটি দায়িত্বশীল পদ থেকে হঠাত করে বললেন, এম ইলিয়াস আলী নাকি পাকিস্তানে গিয়ে জঙ্গি ট্রেনিং নিচ্ছেন ? এতে কি দায়িত্বশীল পদ থেকে জনাবা হুইপ পরিস্কার করে দিলেননা? এম ইলিয়াস আলী যে তাদের কাছেই আছেন?
তাই আজ গ্রাম গঞ্জের চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে শহরের বড় বড় হোটেলের চায়ের টেবিল পর্যন্ত বলাবলি চলছে, সালাউদ্দিন ও হুম্মাম যখন ফিরলেন তাহলে বাকিরা কোথায়? চৌধুরী আলম সহ ইলিয়াস আলীরা কবে ফিরবেন? সেই অপেক্ষায় আজ দেশবাসী।
পাঠক, অতি সম্প্রতি যুক্তরাস্ট্রে স্ট্রেট ডিপার্টমেন্ট, দেশের বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ডগুলিকে বাংলাদেশের মানবাধিকারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এছাড়া গণগ্রেফতার, বেয়াইনী আটকাদেশ, সরকারবাহীনির গুম হত্যা এবং মতপ্রকাশের রোধকে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখছে যুক্তরাস্ট্র। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির পররাস্ট্র দপ্তরের বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন অভিমত তুলে ধরা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে প্রথমবারের মতো এমন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
এদিকে বিশ্ব রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিভিন্নভাবে গুম হওয়া রাজনৈতিক নেতাদের যদি সরকার ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ অবস্থা সৃস্টি হবে এবং বড়দলের জনপ্রিয় নেতাদের খুন, গুম হওয়া স্বাভাবিক হয়ে পড়বে।
অতএব, এই মুহুর্তে ফ্যাচিস্ট সরকারকে অনুধাবন করা উচিত, ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী হয়না। ক্ষমতা অবশ্যই পালাবদল হবে। খুন গুমের এই রীতি পরিহার না করলে, পালাবদলে তখন কি করবেন? তখন তো, কুইনাইন জ্বর সাড়াবে বটে কিন্তু কুইনাইন সাড়াবে কে?
এদিকে এখন সময় এসেছে, অবৈধ ভাবে গুম করে রাখা মানুষের মুক্তির দাবীতে মাঠে নামুন। গোপন সেলের গেইট গুলো খুলে নেবার ব্যবস্থা নিন এবং জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে ডেকে বিভিন্ন সন্দেহজনক স্পট পরিদর্শনের ব্যবস্থা করুন। দেশও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে আওয়াজ তুলুন, ফ্যাসিবাদ সরকারের গোপন কারাগার থেকে, আর কোন প্রকার লুকুচুরি না করে, আজমী-কাশেমী-ইলিয়াস আলী এবং চৌধুরী আলম সহ সকল গুম হওয়া মানুষদেরকে নীজ নীজ স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিন। নইলে লাখো শহিদের অর্জিত বাংলাদেশটির ভাগ্যআকাশে কালো ছায়া দেখা যাচ্চেছ।
লেখক ও কলামিস্ট
সায়েক এম রহমান