ডেস্ক রিপোর্ট::মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রবীণ রাজনীতিবিদ, জগন্নাথপুর উপজেলার ৭নং সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, শাহী ঈদগাহস্থ সৈয়দপুর হাউসের নিবাসী, ন্যাপ নেতা আলহাজ্ব সৈয়দ আব্দুল হান্নান আর বেঁচে নেই। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে সিলেট উইমেন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন।
আলহাজ্ব সৈয়দ আব্দুল হান্নান দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ্য ছিলেন। কিছুদিন আগে অবস্থ্যা আরও বেশ খারাপ হলে সিলেট উইমেন্স হাসপাতালে লাইফসার্পোটে নেওয়া হয়। আজ তিনি ইন্তেকাল করেন।
আলহাজ্ব সৈয়দ আব্দুল হান্নানের জন্ম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি যৌবনের শুরুতেই চাকুরীর উদ্দেশ্যে চলে যান ঢাকার আদমজী জোট মিলস-এ। তখন সেখানে শ্রমিকনেতা ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানী যখন আদমজীতে শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন তখন এই সংগঠনের সেক্রেটারী করা হয় সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে। এই হিসাবে আমরা বলতে পারি তিনি আদমজী জোট মিলস-এর শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। চাচার জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু সেখান থেকে। মাওলানা ভাসানী সভাপতি এবং মাহমুদ আলী সেক্রেটারী হয়ে যখন ন্যাপ গঠন করা হয় তখন থেকে চাচা ন্যাপের রাজনীতি শুরু করেন। ধীরে ধীরে চাচার সাথে গভীর সম্পর্ক হয়ে যায় ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদের। ন্যাপে দুটা গ্রুপ ছিলো, একটা হলো চীনপন্থী, অন্যটা রাশিয়াপন্থী। মাওলানা ভাসানী এবং মাহমুদ আলীরা ছিলেন চীনপন্থী। অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান প্রমূখ ছিলেন রাশিয়াপন্থী।
১৯৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে চীনপন্থীরা ছিলেন পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া-ভূট্টোর পক্ষে, আর রাশিয়াপন্থীরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে। এগুলো দীর্ঘ ইতিহাস। সৈয়দ আব্দুল হান্নান কোনদিন আদর্শচ্যূত হননি, আজীবন ন্যাপই করেছেন এবং অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদের সাথেই থেকেছেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে চীনপন্থী বা ভাসানীপন্থী ন্যাপ চলে যায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পক্ষে। ক্ষমতার রাজনীতিতে অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদের দল থেকে অনেক নেতা বেরিয়ে যোগদেন আওয়ামীলীগে। ধীরে ধীরে ন্যাপে থাকলেন মাত্র কিছু মানুষ। বাংলাদেশের শ্রেষ্ট চেয়ারম্যান হিসাবে সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে যখন স্বর্ণ পদক উঠিয়ে দেওয়া হয় তখন জিয়া বলেছিলেন তাকে বিএনপিতে গেলে পুরস্কৃত করবেন, তখন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে সরাসরি ভূমি মন্ত্রীর অফার দিলে তিনি তাঁর আদর্শের কথা বলে তাও প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু অনেকই তো আদর্শচ্যূত হয়ে সরকারের মন্ত্রী এমপি হলেন?
এক সময় তাঁকে অনেক কৌতুক করে বলতেন, ন্যাপে তো আপনি আর মুজাফ্ফর আহমদ ছাড়া কেউ নেই? তখন তিনি সহজ উত্তর দিতেন, ‘আমি তো ন্যাপে যাইনি কাউকে দেখে, আমি ন্যাপ করি আদর্শের কারণে। ন্যাপ আমাকে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শিখিয়েছে। ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্রের আদর্শ শিখিয়েছে।’
তিনি সত্তরের নির্বাচনে ন্যাপ থেকে কুড়েঘর নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। ন্যাপ ছিলো একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের বুদ্ধিভিত্তিক একটি রাজনৈতিক সংগঠন। ন্যাপের মাধ্যমেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিলো। অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ ছিলেন মুজিব নগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা। বাংলাদেশের সংবিধান মূলত ন্যাপের রাজনৈতিক রাষ্ট্রের খসড়া। সৈয়দ আব্দুল হান্নান ছিলেন একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুনামগঞ্জের সংগঠক। তিনি ভারতে গিয়েও ট্রেডিং নিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তাঁকে দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ ছিলো।
পাকিস্তানি সৈনিকরা তাঁর খুঁজে বাড়িতে তিনবার আসে। তার পিতাকে নৌকায় উঠায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরে ছেড়ে দেয়। যুদ্ধের বছরই তার পিতা হজ্ব করেছিলেন। তিনি হজ্বের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বাড়িতে একা বসে থাকতেন। মূলত এটাই ছিলো তাকে ছেড়ে দেওয়ার মূল কারণ। যুদ্ধের নয় মাস কোন মহিলা-পুরুষ বাড়িতে থাকতে পারেননি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামল মিলিয়ে তিনি মোট সাত বছর ৭ নং সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ভবের বাজার থেকে খাদিমপুর পর্যন্ত যে রাস্তা গিয়েছে তা তাঁর সময়েই করা। ৭ নং সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের যে স্থায়ী ইউনিয়ন অফিস বর্তমানে রয়েছে তাও তাঁর সময়ে করা। তিনি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অনেকবার কারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যদিও তিনি বাম রাজনীতি করতেন, তবে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করতেন, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। মসজিদ-মাদরাসা তৈরিতে অর্থনৈতিক সাহায্য করতেন এবং আলেম উলামাদের সাহায্যে তিনি সর্বদা এগিয়ে থাকতেন। আলেমদেরকে রক্ষার্থে তিনি একবার ২২দিন জেলও কেটেছেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালে সবচেয়ে বেশি ভোট পেতেন আলেমদের পক্ষ থেকে।
ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসা তৈরিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। নিজ গ্রাম সৈয়দপুরে কিংবা তার আশপাশে যখনই কোন সমস্যা হয়েছে তখনই তিনি ঝাপিয়ে পড়তেন সমাধানের জন্য।