বিএনপির সাম্প্রতিক সিরিজ বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েও হাজির হননি দলের অনেক নেতা। এতে ক্ষুব্ধ হাইকমান্ড। তাই দলে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। দলের নির্দেশ অমান্যকারী কিংবা নিষ্ফ্ক্রিয় নেতাদের চিহ্নিত করছেন তারা। তাদের অনেককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। নোটিশের সন্তোষজনক জবাব না পেলে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপি নেতৃত্ব। অনেককে নজরদারিতেও রাখা হয়েছে।
ইতোমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকে অনুপস্থিত নেতাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। কী কারণে তারা বৈঠকে হাজির হননি, সে বিষয়ে তাদের কাছে লিখিত জবাব চেয়েছে হাইকমান্ড। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সরকার পতনের আন্দোলন সফল করতে দলের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কেউ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান দলের গঠনতন্ত্রেই আছে। কেউ গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিএনপি সূত্র জানায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ধারাবাহিক বৈঠক শুরু হয়। প্রথম দফায় দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব ও সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে তিন দিন বৈঠক হয়। পরবর্তী তিন দিন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতিদের সঙ্গে বসেন তিনি।
এসব বৈঠকে অনুপস্থিত ১৩৫ জন নেতাকে গত রোববার কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে এক সপ্তাহের মধ্যে বৈঠকে অনুপস্থিতির কারণ ব্যাখা করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, আব্দুল হালিম, বিজন কান্তি ছাড়াও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম প্রমুখ রয়েছেন। তবে জানা গেছে, অনুপস্থিত নেতাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ এবং বিদেশে রয়েছেন।
জানা গেছে, দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে কোন্দল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে দলটির হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। বিভিন্ন জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌর কমিটি পুনর্গঠনের সময় এ ক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। কমিটি গঠনে কোনো অনিয়ম ঘটলে কিংবা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ সংগঠনের বেশকিছু নেতাকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। হাইকমান্ডের সতর্কতা উপেক্ষা করে এর পর কেউ শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে তাকে বহিস্কারও করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে জেলা পর্যায়ে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন নেতারা। যোগ্য ও ত্যাগীদের পরিবর্তে নিজেদের বলয়ের লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে তারা মরিয়া। এ নিয়ে জড়িয়ে পড়ছেন দ্বন্দ্বে। এসব দ্বন্দ্ব মেটাতে হার্ডলাইনে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ইস্যুতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব যাতে আর না বাড়ে সেদিকে গুরুত্ব দিয়েছে হাইকমান্ড। দলের ঐক্য ধরে রাখা এবং নেতাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শুধু কেন্দ্রীয় ভাবে নয়, তৃণমূলেও যাতে চেইন অব কমান্ড থাকে সেদিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে দলটি। দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে যুক্ত হলে তাদের বহিস্কার করা হবে বলেও সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু দলের এমন কঠোর মনোভাবের মধ্যেও ছাত্রদলসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের আদেশ অমান্য করার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্রদলসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করছে দলের হাইকমান্ড। দলের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতে যোগ্য নেতাদের কাছে নেতৃত্ব তুলে দেওয়াই লক্ষ্য।
ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করতে বিভিন্ন সময় কালক্ষেপণ করছেন সংগঠনের দায়িত্বশীলরা। ঢাকাসহ চার মহানগরীর আহ্বায়ক কমিটি গঠনে নিজেদের লোক দিয়ে পাল্লা ভারি করার প্রবণতায় বিভিন্ন জেলার পদধারী ছাত্রনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারেক রহমান এসব নেতাকে ঢাকা মহানগর কমিটি থেকে বাদ দিয়ে জেলায় রাজনীতি করার নির্দেশনা দিলেও ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তা অমান্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা এ কৌশল নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যেমন নওগাঁ জেলার প্রচার সম্পাদক ফুয়াদকে মহানগরীর পশ্চিমে যুগ্ম আহ্বায়ক করে কেন্দ্র। পরে তারেক রহমান তাকে ঢাকা মহানগরীর পদ থেকে অব্যাহতি দিতে বলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি করেছে উল্টো। তাকে জেলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মহানগরীর পদে রাখা হয়। চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলায় পদ থাকার কারণে আকাশ মিয়াজি ও নিপাকে মহানগর দক্ষিণের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তারেক রহমান। এ নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি। তাদেরকে কচুয়া উপজেলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মহানগরের পদে বহাল রাখা হয়। এ জন্য চার মহানগরীর নবনির্বাচিত আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের ওপর অসন্তুষ্ট। এসব বিষয় দলের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে। জানা গেছে, এখন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছেন তারেক রহমান।
এভাবে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতার বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে দলের হাইকমান্ড। তাদেরকে বিভিন্ন সময় মৌখিকভাবে সতর্ক করা হলেও পাল্টাননি তারা। বরং দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ। এমনকি সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করাতে সহায়তা করছেন বলে কেউ কেউ দাবি করছেন। অভিযুক্তদের প্রত্যেককেই চিহ্নিত করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাদের বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।