নতুন আলো নিউজ ডেস্ক : ঢাকা সফররত ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। সোমবার নিজের কার্যালয়ে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা। তবে ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে এ প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। বৈঠককালে দুই দেশের মধ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যন্ত্র প্রকৌশল এবং সাংস্কৃতিক খাতে সহযোগিতামূলক তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সমর্থন চেয়েছে। ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি ত্রান দাই কুয়াং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। ভিয়েতনাম আমাদের কাছের প্রতিবেশী দেশ। শান্তি ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে দুই দেশ এক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন জনগণের স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন দিয়েছেন। নিপীড়ক বাহিনীর বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের লড়াই আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ষাটের দশকে শিক্ষাজীবনে আমি নিজে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ র্যালিতে অংশ নিয়েছি। ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আন্তরিক আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় আমরা সহযোগিতার নতুন নতুন বিষয় চিহ্নিত করেছি। রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও আমরা বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং কারিগরি সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দ্বিতীয় ফরেন অফিস কনসালটেশন এবং ব্যবসাসংক্রান্ত যৌথ কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক এ বছর অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব সৃষ্টির আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি ‘মেকং-গঙ্গা’ সহযোগিতা ফোরামে যোগদানে আগ্রহের কথাও জানান। শেখ হাসিনা আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হতে ভিয়েতনামের সহযোগিতা কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট কুয়াংকে জানিয়েছি, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌবাহিনী ও ফ্লাইটের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাসহ সমুদ্র ও মহাসাগরে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিয়মভিত্তিক আদেশ বজায় রাখায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ। ১৯৮২ সালের কনভেনশন অনুসারে, আমরা সব সমুদ্র আইন (ইউএনক্লজ) অনুযায়ী আঞ্চলিক ও সমুদ্রবিরোধসহ সব আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আস্থাশীল।’
বাংলাদেশ সফরের জন্য ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াংকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
সংবাদ সম্মেলনে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিভাবে দু’দেশের পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছি আমারা।’
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘দুই দেশের পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে মিল রয়েছে। দুটি দেশেরই অনেক জনসংখ্যা এবং বিশাল বাজার রয়েছে। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আমার একমত হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে আত্মরক্ষা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে পারস্পরিক তথ্য বিনিময় এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের বিষয়েও আমরা একমত হয়েছি। অর্থনৈতিক এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ছিল আলোচনার অন্যতম ইস্যু।’
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট সকাল ১০টায় ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে শেখ হাসিনা তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। দুই নেতার মধ্যে একান্ত বৈঠক শেষে শুরু হয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা, ভিয়েতনামের পক্ষে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ত্রান দাই কুয়াং।
বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করবী হলে দুই নেতার উপস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যন্ত্র প্রকৌশল খাতে সহযোগিতাসহ তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতার বিষয়ে ২০১২ সালে দুই দেশের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক হয়েছিল, এবার তা নবায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবং ভিয়েতনামের কৃষি ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী নুয়েন জুয়ান সেউয়ং সমঝোতা স্মারকে সই করেন। মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং ভিয়েতনামের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার কাও চুয়ক হুয়াং একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেন। আর সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান ও ভিয়েতনামের সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টার ড্যাং থাই বিচ লিয়েন তৃতীয় সমঝোতা স্মারকে সই করেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে রোববার ঢাকা পৌঁছেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং। গত ১৪ বছরে এটাই ভিয়েতনামের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর। ত্রান দাই কুয়াংয়ের সফরসঙ্গী হয়েছেন তার স্ত্রী গুয়েন থি হিয়েনও।
সোমবার সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু করেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট। সেখান থেকে তিনি যান রাজধানীর ধানমণ্ডিতে। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। এরপর যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। বিকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এরপর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সোনারগাঁওয়ের কর্মসূচি শেষে জাতীয় সংসদে যান ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট। সেখানে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন তিনি।
আজ সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের। এরপর সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন তিনি। বিকাল ৩টায় ভিয়েতনামের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী তাকে বিদায় জানাবেন।
Leave a Reply