এম রেজা টুনু সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়েছি। তবুও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভেঙ্গে পড়িনি। তাদের ওপর ভরসা করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। গত দুই বছরে সব স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ু–য়া মেয়ে দুটোর পড়াশোনা বন্ধ। ছোট্ট ছেলেটা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখন দিন মজুরি করে। আরেক ছেলে সারাদিন দোকানে বসে থেকে যে কয় টাকা পায় তা দিয়ে কোনো রকমে সংসারের খরচ চলে। আমি এখন পরের বাড়িতে কাজ করি। আমার সর্বশেষ। এই দুইটা বছর কিভাবে খেয়ে পরে বেঁচে আছি, কোন অবস্থায় আছি, এইটুকু খোঁজখবর পর্যন্ত কেউ রাখেনি। সাংবাদিকদের পেয়ে এভাবেই নিজের পরিবারের বর্তমান অবস্থার কথা বলেন দুই বছর আগে খুন হওয়া সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলাম তৌহিদের মা। খুন হওয়া সন্তানের স্মৃতিচারণায় বিচারের দাবিতে এসময় আহাজারি করে হৃদয়বিদারক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের দক্ষিণ কলাউড়া গ্রাম। এ গ্রামের ভেতরে ডুকে যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে তৌহিদের বাড়ি। এলাকার সবাই এক নামেই চেনে তাকে। রাস্তার পাশে দুটো টিনসেডের জীর্ণ ঘর। একটা ফাঁকা, আরেকটাতে মানুষ থাকে। কেমন যেন অদ্ভুত নিরবতায় আচ্ছন্ন পুরোটা বাড়ি জুড়ে। এ বাড়ির মৃত আব্দুল আহাদের ৬ সন্তানের মধ্যে তৌহিদ সবার বড়। স্থানীয় কলাউড়া বাজারের মসজিদ মার্কেটে বিকাশ ও মোবাইল রিচার্জের ব্যবসা ছিল তার। গত ৯ নভেম্বর বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী তৌহিদ হত্যার দুই বছর পূর্ণ হয়। ন্যায় বিচারের আশায় এখনো দিন গুনছে তার পরিবার। বড় ছেলে হারিয়ে এই দুই বছরে আর্থিক টানাপোড়ন আর মামলার ঘানি টানতে গিয়ে তার পুরো পরিবার ভেঙ্গে পরেছে। পুলিশের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেওয়া এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি বিসমিল্লাহ গার্মেন্টসের ব্যবসায়ী শামীম মিয়া ইতোমধ্যে প্রায় মাস তিনেক আগে জামিনে বের হয়ে এখন কুমিল্লায় অবস্থান করেছে বলে জানা গেছে। প্রধান আসামীর জামিন হলেও, আইনি জটিলতায় বিচারের নিষ্পতি হয়নি এখনোব্দি। মামলাটি এখন পিবিআই’র তদন্তাধীন রয়েছে। তৌহিদ হত্যা মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে চুরির মামলা দিয়ে উল্টো তৌহিদের পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর, প্রতিদিনের মতো এদিনও সকালে ব্যবসার কাজে বাড়ি থেকে কলাউড়া মসজিদ মার্কেটস্থ নিজস্ব দোকানে আসে তৌহিদ। ওইদিন আর বাড়িতে ফেরা হয়নি তার। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। পরের দিন ৯ নভেম্বর সকালে বাংলাবাজার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে জোনাকি জুয়েলারি দোকানের সামনের গলিতে পড়ে থাকা তৌহিদের রক্তাক্ত গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই লোমহর্ষক ঘটনায় ১০ নভেম্বর তৌহিদের পরিবার বাদী হয়ে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে শামীম মিয়া (২৫) এবং পেকপাড়া গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে মনসুর আলী (২৫) কে আসামি করে দোয়ারাবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করে। দুজন আসামিকেই পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মামলার দুই নম্বর আসামি মনসুর আলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মামলার নথিপত্র ও তৌহিদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার দিন ৮ নভেম্বর দুপুরে ছাতকের একাধিক ব্যাংক থেকে কয়েক লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করে বিকাশ ব্যবসায়ী তৌহিদ। এদিন দুপুরে তার সাথেই ছিলেন শামীম ও মনসুর আলী। তারা একসাথে মোটর সাইকেলে করে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় শামীম মিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পূর্ব বাংলাবাজারের বিসমিল্লাহ মার্কেটে ফিরে আসেন। আর এদিন রাতেই খুন হন তৌহিদ। তার পরিবারের দাবি, তৌহিদের সাথে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কারোরই শত্রুতা ছিলনা। মূলত তার সাথে থাকা টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত ভাবে তাকে খুন করা হয়েছে। এই টাকার কোনো হদিস মেলেনি আজোবধি। এই ঘটনার পর পুরো ইউনিয়ন জুড়ে তৌহিদ হত্যার বিচারের দাবিতে বৃহৎ জনমত গড়ে উঠে। সভা সমাবেশও হয়। তৌহিদ হত্যার রক্তের দাগ লেগে থাকা বিসমিল্লাহ গার্মেন্টসও বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাত্র দুই বছর সময়ের ব্যবধানে এখন চাপা পড়ে গেছে তৌহিদ হত্যার বিচারের ইস্যু। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর বিসমিল্লাহ গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে এখনোব্দি দেদারসে চলছে বিসমিল্লাহ গার্মেন্টসের ব্যবসা। কিন্তু তৌহিদের পরিবারের সামান্য খোঁজখবর টুকু পর্যন্ত রাখেনি কেউ। তৌহিদের মা জানায়, ছেলে হত্যার বিচারের নিষ্পত্তি হয়নি। প্রতিবাদ করায় উল্টো আসামি পক্ষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে চুরির মামলা দিয়ে আমাদেরকে হয়রানি করে আসছে। এখনো এই মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। আমি এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি চাই এবং সন্তান হত্যার ন্যায় বিচারের দাবি জানাই। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তৌহিদ হত্যা মামলার বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী এডভোকেট হুমায়ুন মঞ্জুর প্রতিবেদককে জানান, চার্জসীটের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়েছে তৌহিদের পরিবার। নারাজির প্রেক্ষিতে আদালত এটা অধিকতর তদন্তে পাঠিয়েছে। এটা এখন তদন্তাধীন রয়েছে।