অনলাইন নিউজ ডেস্ক: ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের কোনও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ভিয়েতনামের সমুদ্রবন্দরে নোঙর করেছে। কিন্তু এবার তারা ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায়নি, বরং বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবেই ওই অঞ্চলে শক্তি প্রদর্শন করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিয়েতনামের সাথে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পিছনে চীন কীভাবে ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন লিখেছেন বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন হেড। নিচে পাঠকদের জন্য সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটির অনুবাদ দেয়া হল।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সম্প্রতি খুব কমে গিয়েছে, কিন্তু বাজিমাত করার জন্য দেশটির হাতে এখনও একটি শক্তিশালী টেক্কা রয়েছে।
সেটা হচ্ছে যুদ্ধ জাহাজের একটি বহর সমুদ্রে মোতায়েন করা। একটা দৈত্যাকার ‘সুপার ক্যারিয়ার’ বা যুদ্ধ বিমানবাহী জাহাজকে মাঝখানে রেখে যুদ্ধ জাহাজের বহরটি এগিয়ে চলে। পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত জাহাজগুলো থেকে বিমান হামলা চালিয়ে একটা ছোট শহরকে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয়া সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিমানবাহী জাহাজের উপস্থিতি উত্তর কোরিয়ার মতো দেশকে সংযত হওয়ার বার্তা দিবে এবং মিত্র দেশগুলোকে সমর্থন দিবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের ডানাঙ্গে যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ কার্ল ভিনসন পাঠিয়ে দৃশ্যত দেশটির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করল। অথচ মাত্র দুই প্রজন্ম আগেই ভিয়েতনামের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৯৫ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের মধ্যেকার কূটনৈতিক সূসম্পর্কের সূচনা হয়। এরপর থেকেই দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, কূটনীতি ও সামরিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্ধন দৃঢ়তর হয়ে ওঠে।
ভিয়েতনামের কঠোর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এতে ব্যহত হয়নি।
কার্ল ভিনসন এখন যে সমুদ্রবন্দরে অবস্থান তার থেকে অল্প দূরেই ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা প্রথমবারের মতো ভিয়েতনামে অবতরণ করেছিল। ওই জায়গার খুব কাছেই রয়েছে বেশ কয়েকটি ভিয়েতনামের কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র।
এই পটভূমিতে কার্ল ভিনসনের উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্ত এটা দীর্ঘদিন ধরে যত্নের সাথে গড়ে তোলা সুসম্পর্কের পরিণতি।
এর পিছনের মূল কারন হচ্ছে চীনের উত্থান।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধ সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হলেও, প্রতিবেশী দেশ চীনের প্রতি ভিয়েতনামের অসন্তোষ আরও পুরাতন। প্রাচীন কালে সহস্র বছর ধরে যে চীনের শোষণের চালিয়ে আসছে তা ভিয়েতনামের লোকস্মৃতিতে গেঁথে আছে।
চীনের সাথে ভিয়েতনামের এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যেখান দিয়ে ৯০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ঘটে। কিন্তু, ১৯৭৯ সালে এই সীমান্তেই একটি স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধে দুপক্ষেরই কয়েক হাজার সৈন্য মারা যায়।
ভিয়েতনাম ও চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে এক সময় খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। এরপর ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিরোধ দেখা দিলে ভিয়েতনাম সোভিয়েত ইউনিয়নকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করলে চীনের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
১৯৭৮ সালে চীন সমর্থিত খেমাররুজ বাহিনীকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ায় আক্রমণ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই তাদের মধ্যেকার এই বিরোধের অবসান হয়। ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট নেতারা বিভিন্ন দেশের সাথে মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
ওই সময় তারা চীনের সাথে ফের সুসম্পর্ক তৈরি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়, কিন্তু দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে তাদের বিরোধের কারণে তা ব্যহত হয়। দুটি দেশই প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডের অংশবিশেষ দাবী করে এবং তার জন্য যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে।
ভিয়েতনামের মানুষের চীন-বিরোধী মনোভাব খুব সহজেই প্রকাশ্যে এসে পড়তে পারে। ২০১৪ সালে বিরোধপূর্ণ জলসীমায় তেলের মেশিন বসানোয় ভিয়েতনামে সহিংস প্রতিবাদ ছড়িয়ে পরে এবং সেখানে অবস্থিত কয়েকটি কারখানায় চীনের মালিকানাধীন মনে করে সেগুলোতে আক্রমণ চালায়।
২০০২ সালে দক্ষিণ চীন সমুদ্রের উপর দাবীর বিষয়ে চীন সরব হয়ে উঠলে তখন থেকেই ভিয়েতনাম আমেরিকার সাথে যোগাযোগ শুরু করে। তখন, আসিয়ানভুক্ত চারটি দেশ ওই জলসীমার কিছু দ্বীপের উপর মালিকানা দাবী করার পর, চীন আসিয়ানের ‘ডিক্লারেশন অফ কন্ডাক্ট’ বা আচরণবিধি মেনে চলতে মেনে চলতে সম্মত হয়।
কিন্তু তারপরও ওই অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে চীন তাদের বিমান ঘাঁটি, মিসাইল বাঙ্কার ও রাডার স্টেশন স্থাপন তৈরি বন্ধ রাখেনি।
ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়ার পর হিলারি ক্লিনটন ২০১০ সালে আসিয়ানে দেয়া একটি ঐতিহাসিক ভাষণে দক্ষিণ চীন সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়ে তার দেশের আগ্রহের কথা জানান।
হিলারির ভাষণের পরই বারাক ওবামার প্রশাসন দক্ষিণ চীন সমুদ্রকে কেন্দ্র করে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে। এর অংশ হিসেবেই ভিয়েতনামের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করে তারা। ২০১৬ সালে রাজধানী হ্যানয়ে সফরকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ভিয়েতনামে সামরিক অস্ত্র বিক্রির উপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন।
ভিয়েতনামকে ট্র্যান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপেরও (টিপিপি) অংশ করা হয়। চীনের কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়া ঠেকাতে ১২টি দেশ নিয়ে একটি মুক্ত-বাণিজ্য-গোষ্ঠী গড়ে তোলার মাধ্যমে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি রক্ষায় ওবামা এই উদ্যোগ নেন।
টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হওয়ার পরও তা থেকে ট্রাম্পের সরে আসার সিদ্ধান্তে ভিয়েতনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা সত্ত্বেও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নগুয়েন জুয়ান ফুক দক্ষিন এশিয়ার থেকে প্রথম নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে গত বছর দেখা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অঞ্চলে সম্পৃক্ত রাখাই ভিয়েতনামের মূল লক্ষ্য। তাদের জটিল-সুক্ষ কূটনৈতিক কৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ না করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যথাসম্ভব সুসম্পর্ক গড়ে তোলা।
ভিয়েতনামের সাথে এখনও যুদ্ধ কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেনি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিতভাবে কাজ করার বিভিন্ন ক্ষেত্র পর্যালোচনা করে দেখছে।
এখন পর্যন্ত এসবের মধ্যে শান্তি রক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মত প্রতিরক্ষার বিভিন্ন অপ্রচলিত দিক নিয়ে কাজ করেছে তারা। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়া চালালেও ভিয়েতনামের সাথে এমন কিছু করার কথা এখনও শোনা যায়নি। ভিয়েতনামও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাস্ত্র ও যন্ত্র নেয়ার ব্যাপারে এখনও আগ্রহ দেখায়নি।
এমন উদ্যোগ নেয়া হলে তা উস্কানিমূলক মনে করতে পারে চীন। তাই, ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট নেতারা তা এড়িয়ে চলতে চাইবেন।
ডানাঙ্গে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজটি তথাকথিত ‘ফ্রিডম অফ নেভিগেশন’ বা নৌযান চলাচলের স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ চীন সমুদ্র দিয়ে চলাচল করবে। এটিও চীনকে উত্তেজনাপূর্ণ বার্তাই দিবে, কিন্তু তা প্রতীকী।
এখন পর্যন্ত সমুদ্রে চীনের কার্যক্রমের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার কারনে তারা সেখানে সামরিক স্থাপনা তৈরির গতি কমিয়ে দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জাহাজের বহরটি দেখতে বেশ দশাসই, কিন্তু এটি দেখে চীন সংযত হবে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। এমনকি ভিয়েতনামের প্রথম সারির নেতারা হয়ত সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তির পূর্ণ সামর্থ্যের প্রদর্শনী উপভোগ করছেন। কিন্তু যাদের সঙ্গে তারা গাঁটছড়া বাঁধতে চাইছেন, তাদের বিরুদ্ধেই একসময় তারা যুদ্ধ করেছিলেন এটা তাদেরকে মনে রাখতে হবে। একই সাথে ওই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সরে চীনের অনুকুলে যাচ্ছে সেটাও মনে রাখতে হবে।
Leave a Reply