মুহিবুর রেজা টুনু জগন্নাথ পুর থেকে:: সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ১৪ বছর বয়সী কিশোরী মাজেদা নামের একজন রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জনে নেমেছে।
মাজেদার অপরাধ- সে ভাগ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন যুদ্ধে নেমেছে। চায়নি সে অলসের ন্যায় ঘরে বসে থেকে উপোস থাকতে। তাই তো অসুস্থ বাবার রিকশা নিয়ে সে নেমে পড়েছে জীবন যুদ্ধে রাস্তায়।
সপ্তাহখানেক রিকশা চালিয়ে রোজগারও করেছে বেশ কিছু টাকা। মেয়ে লোক বলে অনেকেই তার রিকশায় উঠতে চায়নি।
তবে এতে নাকি সমাজের মান যায়। তাই তো দরিদ্র মেয়েটিকে বাধার সম্মুখীন হয়ে ঘরে বসে পরতে হলো। এখন সে খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে মা-বাবা,ভাই-বোন্দের কে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
স্থানীয় একটি মাতাব্বর মহল প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার রিকশা চালানো বন্ধ করেছে। তাঁরা বলেন আমরা তোমার পাশে আছি থাকবো। কিন্তু রিকশা চালানো বন্ধের তিন দিন পেরিয়ে গেলেও কেউ মাজেদা ও তার পরিবারের আর কোনো খোঁজ নিয়ে দেখতেও আসেনি।
মাজেদা আক্তারের বাড়ি ধর্মপাশা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হলিদাকান্দা গ্রামের উত্তরপাড়া।সে সমোজ আলী(৪৮) ও অজুফার(৪২) সাত সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। বড় দুই বোন আসমা আর সালমার বিয়ে হয়ে গেছে।ছোট দুই বোন জামিলা(৮) আর পাঞ্জুরা (৬) বাকপ্রতিবন্ধী (কথা বলতে পারেনা)। ছোট দুটি ভাই মোহাম্মদ আলী (৩বছর), আহাম্মদ আলী (৩মাস)।
জানা যায় তার বাবা ছিলেন একজন কাঠ মিস্ত্রী। সে (মাজেদা) মাঝে মাঝে তাঁর বাবকে কাঠ মিস্ত্রী কাজে সহায়তা করত। সমজ আলী বলেন যেই বিটা টা দেখছেন তাও চিকিৎসারর জন্য আমার কাকাতো ভাইয়ের কাছে বেইচ্ছা লাইছি। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে আমি এই রিকশাটি কিনছিলাম। কাঠ মিস্ত্রী কাজ না থাকলেই রিকশা নিয়ে বাইরইতাম। অভাবের সংসার বইলা মাইয়াগোরে স্কুলের বারান্দায় পাঠাতে পারিনি।
অসুখের কারণে বেশ কিছুদিন ধইরা রিকশা চালাইতে পারছিনা। তাই মাজেদা আমরারে না কইয়ায় নিজেই রিকশা চালিয়ে ছোট ভাই-বোন আর বাবা-মায়ের মুখে ভাত তুলে দিবে বলে ঠিক করে।
ধর্মপাশা উপজেলা সদরের পূর্ব বাজার থেকে ধর্মপাশা-জয়শ্রী সড়কের কান্দাপাড়া পর্যন্ত রিকশা চালানো শুরু করে সে। এতে তার দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার হতো। কিন্তু রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা এখন খুব কষ্টে আছি।
শুক্রবার সকালে বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মাজেদার সাথে । মাজেদা জানায়, স্থানীয় একটি মাতাব্বর মহল তাঁর রিকশা চালানো বন্ধ করে দেয়। আমি (মাজেদা) রিকশা চালালে নাকি তাদের মান যায় এই বলে আমাকে তারা অনেক কিছুই বলেছে।
‘আব্বার অসুখ দেইখ্যা রিকশা চালাইতাম। যাদের কথায় রিকশা চালানি বন্ধ করছি, হেরার (তাদের) কেউ এহন আমারার খবরও লইছে না’-বলে কান্নায় ভেঙ্গে পরে সে।
মাজেদার মা অজুফা আক্তার বলেন, ‘ছেরি (মেয়ে) দেইখ্যা বেহেই (সবাই) মিইল্যা মাজেদার রিকশা চালানি বন্ধ কইরা দিছে। অভাবের মধ্যে অহন আমরা খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট করতাছি। এখন হ্যারা কই?’
এ বিষয়ে আবদুল আলীমকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এলাকাবাসী এসে তার কাছে অভিযোগ করে- মাজেদার রিকশা চালানোর ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু। সে জন্যই তিনি তাকে রিকশা চালাতে নিষেধ করেছেন।
ধর্মপাশা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য আবুল কাসেম বলেন, ‘মাজেদার বয়স কম। রিকশা চালানোর সময় ঠিকমতো ভারসাম্য রাখতে পারে না। যে কোনো সময় রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই গ্রামের মুরুব্বিদের কথায় তাকে রিকশা চালাতে নিষেধ করা হয়েছে। তাকে সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী মনিকা বেগম বলেন, ‘মাজেদা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাকে নিরুৎসাহিত না করে সবার উচিত ছিল তাকে উৎসাহিত করা। মাজেদা তার মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাক। সমাজের সবাইকে এ সময় মাজেদার পাশে দাঁড়াতে হবে।’
ধর্মপাশা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মদ বলেন, ‘মাজেদা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাকে দমিয়ে দেওয়া উচিত নয়; উৎসাহিত করা উচিত। বিষয়টি আমরা দেখব।’
Leave a Reply